Skip to content Skip to footer

মেসোপটেমিয় ধর্ম: জীবনব্যবস্থার নয়া বুনিয়াদ

দেবতা আন-এর কাছে পবিত্র সংখ্যা ষাট। ফলে হিসাবের পাটাতন দাঁড়ালো ষাট-কে কেন্দ্র করেই। ষাট সেকেন্ডে মিনিট, ষাট মিনিটে ঘন্টা এবং ষাটভিত্তিক বৃত্তের পরিমাপ। হাল আমলেও যার ঐতিহ্য বয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ। মেসোপটেমিয় সভ্যতার উত্তরাধিকার কতটা সমৃদ্ধ, তা আরো স্পষ্ট হয় নগরায়ন, চাকা, লেখালেখি, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, কৃষি, পশুপালনের সূত্র খুঁজতে গেলেই। এস. এন ক্রেমার হিস্ট্রি বিগিনস্ এট সুমের বইতে ৩৯টি নামের তালিকা করেছেন, যাদের গোড়াপত্তন ঘটেছে তাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিসের অববাহিকায়। বিভিন্ন মাধ্যমে তার সাংস্কৃতিক প্রভাব পরবর্তীকালে ছড়িয়ে পড়েছে মিশর, গ্রিস এমনকি সুদূর রোমের মাটিতেও। মেসোপটেমিয় ভাষায় আসু এবং এরেবু শব্দের অর্থ যথাক্রমে পূর্ব এবং পশ্চিম। সেখান থেকেই এশিয়া এবং ইউরোপ শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকের ধারণা। অর্থাৎ সেদিনের পৃথিবীর কেন্দ্র মেসোপটেমিয়া।

সিরিয়ান উপত্যকা ও ফিলিস্তিনে ইতোমধ্যে স্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছিল। তাদেরই একটা অংশ আক্কাদিয়রা সময়ের পরিক্রমায় সরে আসে তাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের উপকণ্ঠ সুমের অঞ্চলে। অর্থাৎ আক্কাদিয়রা সেমেটিক ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হলেও সুমেরিয়রা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধর্মের ইতিহাসে সেই পার্থক্য আরো গভীরভাবে ধরা পড়ে। সুমেরিয় আকাশদেবতা আন (‘আন’ শব্দের অর্থই আকাশ) ছিলেন অনেকটা গুপ্ত। তার জায়গায় আবহাওয়ার দেবতা এনলিল এবং ভূমির দেবতা এনকি ছিলেন প্রভাবশালী। দেবী নামমু সেখানে সকল কিছুর আদিমাতা।

সৃষ্টি

মানুষের উৎস ব্যাখ্যা করতে অন্তত চারটি বিবরণ বিদ্যমান সুমেরিয় ঐতিহ্যে। তাদের পার্থক্যও এত বেশি যে, মনে হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন চারটি সংস্কৃতি সহাবস্থানে ছিলো। প্রথম মিথ অনুসারে, আদি মানব উদ্ভিদের মতোই মাটি থেকে অঙ্কুরিত হয়েছে। দ্বিতীয় মিথ আরো সমৃদ্ধ। স্বর্গের শিল্পীরা মানুষকে তৈরি করেছে কাদামাটি দ্বারা। তারপর দেবী নামমু তৈরি করেছে হৃদয় আর দেবতা এনকি ফুঁকে দিয়েছেন প্রাণ। তৃতীয় মিথে আদিমানবকে সৃষ্টি করেছেন দেবী আরুরু। চতুর্থ সংস্করণ অনুসারে দুই লাহমা দেবতার রক্ত থেকে বিশেষ উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য সৃষ্ট মানবজাতি। শেষ বর্ণনাই বিবর্তিত ব্যাখ্যায় বিখ্যাত হয় ব্যাবিলন আমলে।

মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দেবতাদের সেবা, প্রতিনিধিত্ব এবং অনুকরণের জন্য; Image Source: historyshistories.com

সুমেরিয় মিথের অন্তত দুটো সংস্করণেই মানবসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য দেবতাদের সেবা করা। দেবতাদের উদ্দেশ্যে উপাসনা, উপঢৌকন এবং বলি দেয়া। নববর্ষ, ফসল উত্তোলন এবং অন্যান্য সামষ্টিক উৎসবে অংশগ্রহণ করা। মানুষ কেবল দেবতাদের সেবক নয়, তাদের প্রতিনিধি এবং অনুকরণকারীও। যেহেতু দেবতারাই সৃষ্টিজগতের পরম সিদ্ধান্তের হর্তাকর্তা, মানুষকে সেই আইন অনুসারেই চলতে হবে। এই আনুগত্যেই পাপ আর পূণ্যের ধারণা নিহিত। মানুষের অপকর্ম আর অবাধ্যতায় বারবার কলুষিত হয়েছে দুনিয়া। নববর্ষের মর্তবা এখানেই। প্রতি নববর্ষে পৃথিবী দূষণমুক্ত হয়ে নতুনভাবে জেগে ওঠে। স্বর্গীয় শক্তির স্পর্শে নতুন উদ্যম পায় জমিন। এজন্যই সুমেরিয় ভাষায় নববর্ষ উৎসবকে আকাতিল বলা হতো, যার অর্থ পৃথিবীকে পুনরুজ্জীবিত করার শক্তি।

মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাজা গোদিয়া স্বপ্নে দেখেন, দেবী নিদাবা তাকে নক্ষত্রের গুণাগুণ এবং নাম বোঝাচ্ছেন। একইসাথে একজন দেবতা প্রকাশ করছেন মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা। অর্থাৎ স্বর্গে যথারীতি মন্দির রয়েছে; জমিনে নির্মিত মন্দির মূলত তারই আদলে। সুমেরিয় জ্যোতির্বিদ্যা আর ধর্মচর্চা এভাবে একীভূত হয়ে গেছে।

দুনিয়া অবস্থিত হয়েও মন্দির যেন স্বর্গের টুকরা; Image Source: thoughtco.com

মহাপ্লাবন

ধর্মের ইতিহাসে মহাপ্লাবন অন্যতম আকর্ষণ। সৃষ্টির আখ্যানের ঠিক পরেই মানুষ সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছে একটি মহাপ্লাবনের কথা। শুধু আব্রাহামিক ধর্মগুলো না; প্রত্যেকটি ধর্ম পৃথকভাবে বর্ণনা করেছে এর স্মৃতি। সাধারণত দেবতা বা পরম স্রষ্টা পৃথিবীতে স্থিত সভ্যতাকে নির্মূল করতে মহাপ্লাবনের কলকাঠি নাড়ান। পানি বলতে আদিম স্থিতাবস্থাকে ইঙ্গিত করা হয়। অসীম ও স্থবির পানির মধ্যে থেকেই সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু। আর মহাপ্লাবনের পানি এসেছে ‍বিশ্বব্যবস্থাকে আদিম অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। সৃষ্টিকে পরিচ্ছন্ন করে পুনরায় সৃষ্টির প্রস্তুতি এটি। এই ধরনের প্রায় সব মিথেই একজন নায়ক থাকে। বিশেষ অনুসারী বা পরিশুদ্ধ পুরুষদের বাঁচানোর জন্য তার প্রচেষ্টা টিকে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্মে।

সুমেরিয় মহাপ্লাবনের পুরাণকে আখ্যা দেয়া হয় এরিদু জেনেসিস নামে। এখন অব্দি উদ্ধারকৃত সবচেয়ে পুরাতন মেসোপটেমিয় নিদর্শন। কেন্দ্রীয় চরিত্র সুরুপপাক নগরের যাজক রাজা জিশুদ্র। সুরুপপাক শব্দের অর্থ ‘দীর্ঘদিনের জীবন’। বিবরণী অনুসারে, দেবতা আন, এনলিল, এনকি এবং নিনহুরসাগ পৃথিবী সৃষ্টি করেন। বসবাসযোগ্য পৃথিবীতে তৈরি করেন মানুষ এবং নানা ধরনের প্রাণী। প্রতিষ্ঠা করেন নগর ও বন্দর। কিন্তু মানুষ শীঘ্রই অপরাধ, অন্যায় আর কোলাহলে নোংরা করে তুললো পৃথিবী। মানুষের প্রতি বিরক্তি আর দুনিয়ায় শান্তির জন্যই দেবতা এনলিল মহাপ্লাবনের পরিকল্পনা করলেন। সেই খবর দেবতা এনকি দেয়ালের আড়াল থেকে জানিয়ে দিলেন যাজক রাজা জিশুদ্রের কাছে। বাতলে দিলেন উপায়।

প্রত্যেকটা ধর্ম পৃথকভাবে বর্ণনা করেছে একটা মহাপ্লাবনের স্মৃতি; Image Source:  nationalgeographic.com

পরিকল্পনানুসারে এক লম্বা নৌকা তৈরি করলো জিশুদ্র। তাতে ওঠালে মানুষ আর পশুপাখি। যথাসময়ে প্লাবন এলো। সাত দিন সাত রাত ধরে অঝোর বৃষ্টি। তামাম পৃথিবী তলিয়ে গেল পানির নিচে। আকাশ শান্ত হলে জিশুদ্র নৌকা থেকে নেমে কোরবানি করলো সূর্যদেবতা উতু শামাশের উদ্দেশ্যে। আন আর এনলিল নিজেদের হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত হলেন। মানবজাতি রক্ষার জন্য জিশুদ্রকে দেয়া হয় দিলমুন নামের স্বর্গে। মহাপ্লাবনের এই ব্যাখ্যাই একটু এদিক-ওদিক হয়ে পরবর্তী মেসোপটেমিয় ধর্মবিশ্বাসে বাহিত হয়েছে।

দুনিয়া

সম্রাট লাগালজাগিসির আমলে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ২৩৭৫ অব্দের দিকে স্বর্ণযুগ ছিল সুমেরের। তারপর ক্রমশ অবক্ষয় এবং আক্কাদিয় সম্রাট সারগনের মাধ্যমে বিস্তৃতি ঘটে আক্কাদিয় সাম্রাজ্যের। এক শতাব্দী পরে তা-ও স্তিমিত হতে থাকে। সুমের এবং আক্কাদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল। তবে সুমেরিয় ভাষা ক্রমশ মলিন হতে থাকে। প্রাধ্যান্য হারাতে থাকে আন, এনলিল এবং ইয়ার মতো দেবতারাও। সেই স্থান দখল করে নিতে থাকে মারদুক, ইশতার এবং শামাস।

“বিশ্বজগতের সৃষ্টি কীভাবে?” সেই প্রশ্নের সুমেরিয়-আক্কাদিয় চিন্তায় উত্তর দিয়েছে এনুমা এলিশ। তিয়ামাত ছিলেন লোনাপানির দেবী আর আপসু মিঠা পানির দেবতা। তাদের সন্তান আনশার এবং কিশার। তাদের থেকে আকাশ দেবতা আনু এবং আনুর থেকে দেবতা ইয়া জন্মলাভ করে। তবে এনুমা এলিশের মূল আখ্যান দেবতা মারদুককে নিয়ে। দেবতা ইয়া আর দেবী দামকিনার সন্তান মারদুক।

মারদুক পরিণত হয় প্রধান দেবতায়; Image Source: timeslive.co.za

বিশ্বজগতের প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে আপসু। সিদ্ধান্ত নেয় সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। সিদ্ধান্তটা তিয়ামাতকে আতঙ্কিত করলে জানিয়ে দেয় ইয়াসহ অন্যান্য দেবতাদের। ইয়াই অবশেষে আপসুকে ঘুম পাড়িয়ে হত্যা করে। কিন্তু তিয়ামাত এটা চায়নি। প্রতিশোধের সিদ্ধান্তে উন্মত্ত হয়ে ওঠে তাই। তার সাথে যোগ দেয় দেবতাদের কেউ কেউ। এবার কেবল ইয়া না; দেবলোকের অন্য দেবতারাও ভীত হয়ে ওঠে তিয়ামাতের ক্রোধ দেখে। উপায়ন্তর না পেয়ে সকলে দ্বারস্থ হয় মারদুকের। দেবকূলের মধ্যে শীর্ষস্থান পাবার শর্তে শত্রুর মুখোমুখি হয় মারদুক। প্রবল রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে পরাজিত করে তিয়ামাত ও তার অনুসারীদের। মৃত তিয়ামাতের দেহ দুই ভাগ করে একভাগ দিয়ে আকাশ, আরেকভাগ দিয়ে জমিন তৈরি করে মারদুক। শরীরের অন্যান্য অংশ দিয়ে প্রস্তুত হয় গ্রহ, তারা এবং স্বর্গ। তিয়ামাতের সহচর কিঙ্গুকে হত্যা করে সেই রক্ত দিয়ে তৈরি করা হয় মানুষ। মানুষ সৃষ্টি এবং মহাবিশ্বের উৎস সংক্রান্ত বেশ জটিল এই মিথ মেসোপটেমিয়ার পরবর্তী সংস্কৃতিতেও প্রচলিত হয়েছিল।

গিলগামেশ

ব্যাবিলনিয় সংস্কৃতি থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন মহাকাব্য গিলগামেশ। তার অভিযাত্রার সুমেরিয় সংস্করণ পাওয়া গেলেও সেমেটিক বিবরণীই বেশি জনপ্রিয়। উরুকের রাজা গিলগামেশ। দেবী নিনসুন এবং ধর্মযাজক লুগালাবান্দার পুত্র। অর্থাৎ গিলগামেশ মানুষ হয়েও দৈব ক্ষমতার অধিকারী। তবে সেই ক্ষমতা প্রথম দিকে জনকল্যাণে ব্যবহৃত হলেও ধীরে পরিণত হয় প্রজাপীড়নের প্রধান নিয়ামকে। ক্রমশ তা এতটাই চরম রূপ নিল যে, গিলগামেশ রাজ্যের নারী এবং কন্যাদের কিছুদিনের জন্য রাখতেন নিজের সন্তুষ্টির জন্য, আর পুরুষদের দিয়ে করাতেন শারীরিক শ্রম।

কাতর জনতা মন্দিরে মাথা ঠুকল। চাইল পরিত্রাণ। দেবতাদের হৃদয় বিগলিত হলো। গিলেগামেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সৃষ্টি করা হলো আধা-অসভ্য এনকিদু। সবদিকেই সে গিলগামেশের ন্যায়, কেবল শরীরটা লোমে ঢাকা। প্রথমদিকে বনেই বসবাস করতে থাকে এনকিদু। গিলগামেশ প্রথমে স্বপ্নযোগে এবং পরে এক শিকারির কাছে থেকে তার সম্পর্কে জানতে পারেন। আধা-সভ্য মানুষটাকে বন থেকে বের করতে এক সুন্দরীকে প্রেরণ করলেন সম্রাট। এনকিদু নগরে এসেই গিলগামেশের কাহিনী শুনল। আর শুরু হলো এক প্রলয় সংঘাত। যেহেতু দুজনেই সমান, তাই এই যুদ্ধ চলতে পারত অনন্তকাল। বুঝতে পেরে একসময় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল বন্ধুত্বের মাধ্যমে।

গিলগামেশ কেবল সাহিত্য না, ধর্মচিন্তার দলিলও; Image Source: actualidadliteratura.com

সেই বন্ধুত্বের তুলনা নেই। গিলগামেশ আর এনকিদু মিলে অভিযান চালালেন নানাদিকে। হত্যা করলেন দানব হুম্বাবাকে। ফেরার পথে দেবী ইশতার গিলগামেশকে দেখে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি অপমানসহ প্রত্যাখ্যান করলেন। সেই ইশতারই ক্ষুব্ধ হয়ে ষাড় নিয়ে আসল গিলগামেশকে শায়েস্তা করার জন্য। হয়তো উদ্দেশ্য সফলই হতো; কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল এনকিদু। হত্যা করল ষাঁড়কে। এদিকে দেবতারাও ক্ষিপ্ত হয়ে কেড়ে নিলেন এনকিদুর প্রাণ। গিলগামেশের সবচেয়ে প্রিয় মানুষের প্রাণ। গিলগামেশও দমবার পাত্র না। মৃত্যুকে জয় করার জন্য দিকে দিকে চালালেন অভিযান। দেখা করলেন মহাপ্লাবনে বেঁচে থাকা মৃত্যুঞ্জয়ী উৎনাপিশতিমের সাথে। ঘরে ফিরলেন সঞ্জীবনি লতা নিয়ে; যে লতা মানুষকে মৃত্যু থেকে ফেরাতে পারে। কিন্তু নিয়তি বড় কঠিন। লতাটা তিনি হারিয়ে ফেলেন পুকুরে গোসল করার সময়। নিয়ে যায় একটা সাপ। এনকিদুকে আর ফেরানো হয় না।

নিয়তি

নিয়তিকে ঠিক কতটা প্রভাবশালী হিসেবে দেখা হয়েছে মেসোপটেমিয়ায়, তার প্রমাণ ওই আখ্যান। একদিকে উৎনাপিশতিমের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, কিছু মানুষ দেবতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় অমরত্ব লাভ করতে পারে। অন্যদিকে গিলগামেশের মতো মহাপরাক্রমশালীর প্রচেষ্টাতেও এনকিদুর নিয়তি বদলানো গেল না। সুমের থেকে ব্যাবিলন অব্দি প্রায় গোটা সভ্যতা জুড়েই দেবতাদের একচেটিয়া আধিপত্যে মানব অস্তিত্বের আর্তনাদ ততটা জোরালো হতে পারেনি। মানুষ যেন নিয়তির হাতের পুতুলমাত্র। যদিও পরবর্তী সেমেটিক ধর্ম সেই ধারণা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে।   

আক্কাদিয় ধর্মে মানুষের সম্ভাব্যতার একটা সীমারেখা টানা হয়েছে। মানুষ এবং দেবতার মধ্যকার ব্যবধান অতিক্রম করা অসম্ভব। মানুষের সীমাবদ্ধতা অগাধ। যদিও সে ভেতরে দেবতাদের দেয়া আত্মা বহন করে। যদিও সে উপাসনার মাধ্যমে দেবতাদের অনুগ্রহ পেতে পারে। মন্দিরগুলো তাই এমন স্থান, যেখান থেকে মানব আত্মা দেবতাদের থেকে শক্তি গ্রহণ করে শক্তিমান হয়ে ওঠে। ব্যাবিলন শব্দটি এসেছে বাব-ইলানি থেকে, যার অর্থ দেবতাদের দরজা। অর্থাৎ যেখানে দেবতা হাজির হয় কিংবা যেখান দিয়ে দেবতার সামনে হাজির হওয়া যায়। অর্থাৎ যা ইহজগত এবং পরজগতের মধ্যে সংযোগ।

খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগের সুমেরিয় দেয়ালচিত্র; Image Source: Wikipedia

সবিশেষ

সুমেরিয় সংস্কৃতিতে বেহেশত পরিচিত হতো দিলমুন নামে। সেখানে থাকে দেবতারা। মানুষের মৃত্যুর পরে আত্মা যায় পাতালে। যাদের শেষকৃত্য যথাযথভাবে হয়নি, সেই সব আত্মা দুনিয়ায় ফিরে এসে অত্যাচার করে। কবর সাধারণত দেয়া হতো বাড়ির পাশেই। ফলে প্রতিটি বাড়ির সাথেই সমাধিস্তম্ভ বিদ্যমান। মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে খাবার উৎসর্গের রীতিও অপ্রচলিত ছিল না। কবিরাজদের কর্মপ্রণালিও ছিল অনেকাংশেই ধর্মনির্ভর। নারী এবং পুরুষদের জন্য গৃহীত হতো ভিন্ন ব্যবস্থা।

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকেই মেসোপটেমিয় সভ্যতার সৃজনশীল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আরো পরে পতন ঘটেছে তাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসের উর্বর ভূমির। কিন্তু কয়েক সহস্রাব্দ ধরে যে ঐতিহ্য বড় করে তুলেছে তারা, তা ছড়িয়ে পড়েছে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য। ওদিকে ভূমধ্যসাগরের পশ্চিম তীর থেকে এদিকে হিন্দুকুশ। বিশেষভাবে প্রবাহিত হয়েছে কানান তথা ফিনিশিয় অঞ্চল। পরবর্তী হিব্রু সভ্যতার উত্থান এবং পুনর্গঠনে সেই সব বিশ্বাসের প্রভাব মোটেও উপেক্ষণীয় ছিল না। আদমের পতন, হাবিল-কাবিলের সংঘাত, নুহের মহাপ্লাবন, আইয়ুব নবির ধৈর্য্যসহ অন্যান্য আখ্যানের পটভূমি তৈরি হয়েছে মেসোপটেমিয়াতেই। সেটাই সেমেটিক নবি ইবরাহিমের জন্মস্থান। বাইবেল এবং নিউ টেস্টামেন্টও তার দলিল।

Leave a comment

Magazine, Newspapre & Review WordPress Theme

© 2025 Critique. All Rights Reserved.

Sign Up to Our Newsletter

Be the first to know the latest updates