Skip to content Skip to footer

ইন দ্য বিগিনিং: শিকার সভ্যতায় ধর্মচিন্তার হালচাল

তখনো মানুষ স্থায়ী সভ্যতা গড়ে তোলেনি। যাযাবর জীবনের স্বাদকে করেনি অগ্রাহ্য। কিন্তু ভাবতে শিখেছে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। কেবল যন্ত্র আবিষ্কার করেই থামেনি। তা তো অন্যান্য নিকটাত্মীয় প্রাণীর মধ্যেও দেখা যায়। পাথর দিয়ে বাদাম থেতলানোর কাজ বানরও পারে। মানুষ যন্ত্র বানানোর যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। পাথর দিয়ে তৈরি করেছে শিকারের যন্ত্র। ইতিহাসের আদিতম প্রযুক্তি। ব্যবহার করেছে ধাতব দ্রব্যাদি। পাশাপাশি আগুনের ব্যবহার রপ্ত করাটা যেন নিয়ন্তায় পরিণত করলো। আগুন উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং পরিবহনের কারণে কেবল শিকারই সহজ হলো না। অন্ধকার রাতগুলো হলো নির্ভয় ও নিরাপদ, পরিপাকতন্ত্রের উপর কমলো চাপ।

অস্তিত্বের প্রয়োজনেই মানুষ জন্ম দিয়েছে সম্মুখ, পেছন, ডান এবং বাম দিকের ধারণা। চারটি দিক বৃত্তের মতো বিস্তৃত, যার সৃষ্টি উপর আর নিচ বরাবর অক্ষকে কেন্দ্র ধরে নিয়ে। অর্থাৎ মানুষ নিজেকে আপাত অসীম পৃথিবীর কেন্দ্রে দেখতে পেয়েছে। নিজেকে বিশ্বজগতের কেন্দ্রে বিশ্বাস করাটা চিন্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যা থেকে রচিত হয়েছে বিশ্বাসের পরবর্তী পাটাতন। অবচেতন মনের কল্পনা, স্বপ্ন, বৌদ্ধিক তৎপরতাগুলো হাজির হয়েছে নানান রূপে। পরিণত হয়েছে প্রাত্যহিক চর্চায়। পাশাপাশি বেড়ে উঠেছে অজস্র উপকথা, কিংবদন্তি আর বিশ্বাসের।

কবর

শিকার সভ্যতায় অন্যান্য জীবজন্তুকেও প্রায়শ মানুষের ন্যায় গণ্য করা হতো। মৃত্যুর পরে মানুষ জন্তুতে কিংবা জন্তু মানুষে পরিণত হতে পারে। একটা বিশেষ ব্যক্তি আর বিশেষ প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান সেই সম্পর্ক। স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বন্য জন্তুর অভিভাবক, জঙ্গল কিংবা বিভিন্ন প্রজাতির আত্মাকে। ফলে প্রাণী শিকারের সময় পালিত হতো বিশেষ উপাসনা। যেন বনের অভিভাবক দেবতার কাছে এই বলে প্রার্থনা করা হচ্ছে, হত্যাযজ্ঞটা অনর্থক না। কেবল খাদ্যের প্রয়োজনেই এই শিকার। তারপর রেখে যাওয়া হতো হাড়গুলো। যেন দেবতা তাতে পুনরায় মাংস গজিয়ে দেন। এইজন্যই প্রত্নতাত্ত্বিকদের খননে উঁচু ভূমি বা নদীর পাড় থেকে হাড় পাওয়া যায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে প্রাপ্ত হান্টার-গেদারার যুগের তিনটি দেহাবশেষ © Lasdislav Varadzi 

যেসব কবরের চিহ্ন মিলেছে, তাদের বয়স ৭০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ অব্দি। কিন্তু তাদের পেছনে রহস্য কী? বিশ্বাস এবং আদর্শ ফসিল হয়ে থাকে না। ফলে নিখুঁত উত্তরও বের করে আনা কঠিন। মৃতদের নিয়ে দেখা স্বপ্ন কিংবা মৃতের ফিরে আসায় বিশ্বাস কবরের কারণ হতে পারে। হতে পারে মৃতদেহের অস্বাভাবিক বিকৃতির প্রতি ভয় কিংবা পুনর্জন্ম ধারণার বিস্তার। যেটাই হোক, দিন শেষে তা ধর্ম চর্চাতেই পর্যবসিত হয়েছে। খননকৃত কবরগুলো প্রায়শ পূর্ব অভিমুখে। যা মৃত্যুর সাথে সূর্যকে সম্পর্কিত করার প্রয়াস। সূর্য যেভাবে প্রতিদিন ফিরে ফিরে আসে। কবর প্রদানকরীরা সেভাবেই প্রত্যাশা করেছে মৃতের ফিরে আসায়। এ কারণেই হয়তো সাথে দিয়েছে ব্যবহার্য সামগ্রী, সজ্জিত করেছে কবর। মাটিতে ঢাকার আগে এবং পরে সম্পাদিত হয়েছে বিশেষ রীতি।

সংরক্ষিত হাড়

আল্পস পর্বতমালা এবং আশেপাশের অঞ্চলে গুহাভালুকের প্রচুর হাড় পাওয়া গেছে। সাথে শিকার করা প্রাণীর হাড় এবং মাথার খুলি। গুহার মেঝে থেকে একটু উপরে তাকের মতো জায়গায় রাখা হাড়গুলো। বিষয়টা সচেতনভাবেই সংঘটিত। শিকারিরা গুহাভালুকের অভিভাবক কোন দেবতায় বিশ্বাস করতো। তাই শিকারের পর গুহায় লম্বা হাড় এবং মাথার খুলি সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেন হত্যা হওয়া জন্তুদের পরবর্তী বছর দেবতা পুনরুজ্জীবিত করেন।

শিকারের পর গুহায় লম্বা হাড় এবং মাথার খুলি সংরক্ষণ করা হয়েছে; Image Source: fossilguy.com

হাড়গুলো তাই দিনশেষে দেবতার কাছে একপ্রকার উৎসর্গকেই নির্দেশ করে। ফলে যেন কুকুরের মতো কোনো প্রাণী হাড়গুলো নষ্ট করে না ফেলে, তাই পুঁতে রাখা হয়েছে যত্ন করে। সংরক্ষণ করা হয়েছে প্রত্যাবর্তনের আশায়। গণ্য করা হয়েছে সঠিক আদব হিসেবে। উত্তর গোলার্ধের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এই চর্চা হাল আমলেও দেখা যায়। ঠিক এই কারণেই মাংস খাওয়ার পরে হাড় ভাঙতে নিষেধ করা হয় অন্য আদিবাসী সংস্কৃতিতে।

গুহাচিত্র

আদিম সভ্যতার রেখে যাওয়া দলিলের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ধারা গুহাচিত্র। পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপ এবং রাশার ডন নদীর অববাহিকা এই ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ। গুহাগুলোর প্রবেশপথ থেকে বেশ দূরে অবস্থিত চিত্রকর্ম। বসবাসের অনুপযোগী এইসব গুহা। মূল অংশ থেকে চিত্রিত অংশে পৌঁছাতে রীতি মতো কায়দা-কসরত ও সময় খোয়াতে হয়। ফলে চিত্রগুলো যে নেহায়েত খেয়ালের বসে জন্ম দেয়া হয়নি, তা নিশ্চিত। ভালো করে তাকালেই স্পষ্ট হতে থাকে ভালুক, সিংহ, বাইসন এবং অন্যান্য প্রাণীর পাশে ধাবমান তীর। কারো গায়ে স্বচ্ছ্ব করে আঁকা তীরের আঘাতে ক্ষতচিহ্ন। হতে পারে শিকারে যাবার আগে বিশেষায়িত এই স্থানে পালিত হতো বিশেষ আচার।

স্পেনেই আলতামিরার এই আদিম চিত্রকর্ম একই সাথে ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতিও? Image Source: Wikimedia Commons 

বর্তমান সময়েও শামানিজম শিকার এবং গ্রামপ্রধান আদিবাসী গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে। যেখানে মানুষ বনাম প্রাণীর মধ্যে অদ্ভুত আধ্যাত্মিক সংযোগ কল্পনা করা হয়। আদিম সেই গুহাচিত্র প্রকারান্তরে শামানদের চর্চার স্বাক্ষরই বহন করে। সাইবেরিয়ার এসকিমো হোক, কিংবা আমেরিকার ওজিবওয়ে- বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এই চিত্রকর্ম ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিল শিকারের সাথে।

নারী

সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো পাথর ও হাড় দ্বারা নির্মিত কিছু আদিম নারীমূর্তি। দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্স থেকে সাইবেরিয়ার বৈকাল অব্দি অব্দি কমবেশি সেই নিদর্শন পাওয়া যায়। পাঁচ থেকে পনেরো সেন্টিমিটার উচ্চতার মূর্তি নির্মিত হয়েছে শেষ বরফ যুগে। কেবল নারীর স্পষ্ট অবয়ব না, পাওয়া গেছে পাখিমূর্তি এবং স্বস্তিকার মতো জ্যামিতিক কাঠামোও। উত্তর এশিয়ার শিকারি গোত্ররা ‘জুলি’ নামে মূর্তির উপাসনা করে। মনে করা হয়, জুলি সকল প্রাণীর আদিমাতা। তিনিই গোত্রকে রক্ষা এবং বসবাসকে নিরাপদ করেন। শিকার থেকে ফেরার পর তার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। এই থেকে আদিম সেই নারীমূর্তিকেও ব্যাখ্যা করা যায়।

প্যালিওলিথিক যুগের নারীমূর্তি ধর্মজীবন সম্পর্কে বিচিত্র ধারণা দেয়; Image Source: siberiantimes.com

শিকার যুগেই নারী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রচ্ছন্নভাবে গুহায় অঙ্কিত চিত্রকর্মেও সে হাজির। ঘোড়াকে পুরুষ আর বাইসনকে নারী হিসাবে পাঠ করা যায়। সেখানে পাখিগুলো যেন আত্মা। এভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস আবির্ভূত হয় রূপকের ছদ্মবেশে। যতই সময় গড়াচ্ছে, মানুষ প্রমাণিত হচ্ছে গ্রহের আদি থেকে আদিতম অধিবাসীতে। প্রমাণিত হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের জটিলতা। স্থায়ী সভ্যতায় যাকে লেখা, গণনা এবং পঞ্জিকা বলে গণ্য করা হয়, শিকার যুগেও তা ছিল ভিন্ন অবস্থায়। দেয়ালে অঙ্কিত শিল্পকর্মে আদিম গোত্রপতি কোন হিসাব রেখে গেছে। কোন তরুণী তার প্রিয়তমের জন্য করেছে দিনগণনা। কোন যাজক নির্ণয় করেছে উৎসর্গের সঠিক সময়। তাদের ব্যবহৃত প্রতীকগুলো যেন একেকটা গল্প। ঋতু, খেলাধুলা, যৌনতা, মৃত্যু, অলৌকিকতা এবং বিশেষ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্কিত গল্প। যা জন্ম দিয়েছে শিকারি সমাজে বিশেষ বিশেষ উৎসবের ধারণা।

আত্মা

আদিম সেই সমাজে আত্মার ধারণাই শামানবাদের মূল ভিত্তি। আত্মার আইডিয়া আসলো কোত্থেকে? এডওয়ার্ড টেইলরের উত্তর- ঘুম। ঘুমালে মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে অন্য জগতের সাথে পরিচিত হয়। স্বপ্নে দেখা স্থান আর সময় বাস্তব জীবনকে ছাপিয়ে আলাদা অস্তিত্বের ইশতেহার জারি করে। কারণ, শরীর বিছানায় পরে থাকলেও নানা জায়গায় ঘুরে আসা যায় ঘুমে। ওই অভিজ্ঞতাকে মিথ্যাও বলা যায় না। সুতরাং নিজের ভেতরে গড়ে উঠে দ্বৈত অস্তিত্বের ধারণা। জাগরণে থাকাকালীন শরীরপ্রধান রুটিনের চেয়ে ওই অশরীরী অস্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ, তাতে আছে বিস্ময়কর দ্রুততা। তার শক্তি অপার। তার সক্ষমতা সীমাহীন। সুতরাং ওই অশরীরী অস্তিত্বের যত্নে পালিত হতে থাকে বিভিন্ন কাজ। এবার যদি কোনো পূর্বপুরুষের মৃত্যু ঘটে, তবে তার আত্মার প্রতি অবনত হওয়া শুরু হয়। তার কাল্ট তৈরি করে শ্রদ্ধার্থে কিছু রীতি পালন করা হতে থাকে। তার উদ্দেশ্যে খাবার উৎসর্গ করা হয়। এভাবে আত্মা আকার ধারণ করে প্রতিমার। অর্থাৎ মানুষের প্রথম উপাস্য- পূর্বপুরুষ। প্রথম সেক্রিফাইস- খাবার। আর প্রথম ইবাদতখানা- কবর।

মানুষের বেঁচে থাকবার আকাঙ্ক্ষা রেখে গেছে দেয়ালে; Image Source: thoughtco

প্রথমত, আত্মা শরীর থেকে মুক্ত হয়ে যথেচ্ছা ভ্রমণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই ভ্রমণে অলৌকিক সত্তার সাথে আত্মার সাক্ষাৎ ঘটে। শামান চর্চায় অনেক অসুস্থতাকেই জীবিত মানুষের উপর মৃতের আত্মার কিংবা কোনো অলৌকিক সত্তার আছর হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। তার উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় উপাসনার রেওয়াজ।

সবিশেষ

শিকারের আগে কেবল বয়স্ক পুরুষদের বিশেষ রেওয়াজ-রসম প্রচলিত ছিল। একইভাবে ছিল নাবালক সন্তান পুরুষ হিসেবে সমাজের কর্তামহলে স্বীকৃত হবার সময়। সৃষ্টি সংক্রান্ত বিশ্বাস তো আগে থেকে প্রচলিত। বিশ্বাসে তাই আকাশ, পানি এবং পাখির প্রভাব উপেক্ষা করার মতো না। অবশ্যই তাদের কেন্দ্র করে উপকথা ও কিংবদন্তি জায়গা করে নিয়েছিল। শিকার সমাজে আগুন এক বিস্ময়ের নাম। তার অবস্থানও দূরবর্তী না। একইভাবে আলো এবং অন্ধকার, বৃষ্টি এবং রংধনু গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং পরিবারের প্রিয় সদস্যদের মৃত্যু মানবচিন্তায় ভয় ঢুকিয়েছে। পুনর্গঠন করেছে বিশ্বাসের প্যাটার্ন।

আবহাওয়াগত ভিন্নতার কারণে ভিন্ন অঞ্চলের সমাজ ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। গোত্রগত ভিন্নতার কারণে বৈচিত্র্য দেখিয়েছে টোটেম ও ট্যাবু ধারণায়। এমনকি ব্যক্তিভেদেও বিশ্বাস সমান হয়নি। কেউ হয়তো শিকার যন্ত্র প্রস্তুত করতে দক্ষ আবার কেউ পশুকে ধাওয়া করতে। উভয়ের উপর বিশ্বাস একইভাবে প্রভাব ফেলেনি। তাদের দ্বারা বিশ্বাসের সব বিষয়ও সমান গুরুত্ব পায়নি। অথচ ভাষা আবিষ্কারের আগেও মানুষের ভয় ছিল, স্বপ্ন, কল্পনা এবং ক্ষমতার ধারণা ছিল। ফলে শত ভিন্নতা নিয়েও আশ্রয় নিয়েছে ধর্মের দুয়ারে। ধর্ম তৈরি করে দিয়েছে প্রাথমিক সমাজ। ব্যক্তি অস্তিত্বের সাথে জীবন ও জগতের সম্পর্ক। শত প্রতিকূলতায় কেবল বেঁচে থাকার শক্তিই পায়নি; পেয়েছে মৃত্যুর পরে ফিরে আসার আশ্বাস।

Leave a comment

Magazine, Newspapre & Review WordPress Theme

© 2025 Critique. All Rights Reserved.

Sign Up to Our Newsletter

Be the first to know the latest updates